জেন্ডার ধারণা

ছেলে ও মেয়ে শিশু উভয়ই সমান সম্ভাবনা নিয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে। শুধুমাত্র শারীরিক গঠনে এবং শরীরবৃত্তীয় কাজে কিছু পার্থক্য থাকে যা প্রাকৃতিক। শারীরিক এই পার্থক্যের কারণে মেয়েরা গর্ভধারণ করে, সন্তান জন্ম দিতে পারে, অন্যদিকে ছেলেরা ভ্রুণ উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। ছেলে ও মেয়ে বা নারী ও পুরুষের মধ্যে এই পার্থক্য প্রকৃতগত, যা চিরন্তন, অপরিবর্তনীয়।

ছেলে ও মেয়ে বা নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রকৃতগত এই পার্থক্যকে ভিত্তি করে, সমাজ ছেলে আর মেয়ের ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা ও অধিকার নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। যেমন, বহুদিন ধরে মেয়েরা ঘরের কাজ, রান্না, সন্তান লালন পালন, এই সব গৃহস্থালি কাজ করে আসছে, যার বিনিময়ে কোনো পারিশ্রমিক হয় না। অন্যদিকে ছেলেরা আয় উপার্জন, বিচার সালিশ, রাজনীতি ইত্যাদি কাজের সাথে যুক্ত। ছেলে এবং মেয়েদের সাজ-সজ্জা, আচার আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদও আলাদা। ছেলে এবং মেয়েদের অধিকারও এক নয়। ছেলে ও মেয়ের উপর সামাজিকভাবে আরোপিত এই পরিচয় বা ভূমিকাকেই জেন্ডার বলে ।

সমাজের তৈরি এই পার্থক্যর ফলে মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে। সৃষ্টি হয়েছে নানা ধরনের বৈষম্যমূলক সামাজিক ভূমিকা ও আচার আচরণ। তবে যুগের প্রয়োজনে বর্তমানে মেয়েরা শিক্ষা, রাজনীতি এবং আয় উপার্জনমূলক কর্মকান্ডে ধীরে ধীরে অংশগ্রহণ করছে। সুতরাং জেন্ডার ভূমিকা পরিবর্তনযোগ্য।

ছেলে ও মেয়ের মধ্যে বা নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্যমূলক আচরণ

বাংলদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। সমাজে পুরুষের তুলনায় নারীর অবস্থান নিচে বলে মনে করা হয়। ফলে জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মেয়েরা বা নারীরা বৈষম্যের স্বীকার হয়। জীবনের প্রায় ক্ষেত্রেই একজন নারী বা একটি মেয়ে মানুষ হিসেবে তাদের যে প্রাপ্য, সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। ছেলে ও মেয়েকে সমান চোখে দেখা হয় না, সমান সুযোগ ও সমান অধিকার দেয়া হয় না, মেয়ে শিশুদের প্রতি অযত্ন আর অবহেলা প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। সামাজিক নিয়মের কারণে ছেলেরা পারিবারিক নাম বা বংশের ধারক। বাবা-মা বৃদ্ধ হলে ছেলেরা তাদের দায়িত্ব নেয়। পিতামাতার দায়িত্ব মেয়েদের উপর দেয়া হয় না। মেয়েরা বিয়ের পর স্বামীর ঘরে চলে যায়, তারা স্বামীর উপর নির্ভরশীল, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নেই, উপার্জন করার ক্ষমতা নেই, বা উপার্জন করলে তার উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই মেয়েদের শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের জন্য বাবা-মা খরচ করতে চায় না। ফলে শিক্ষা, পুষ্টি, চিকিৎসা সব ক্ষেত্রেই অবহেলার শিকার হয় মেয়েরা। সমান সম্ভাবনা থাকার পরও একটি মেয়ে একটি ছেলের মত একইভাবে দক্ষ হয়ে উঠতে না পেরে পদে পদে পিছিয়ে পড়ে। অথচ যথাযথ সুযোগ পেলে উভয়ই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আয় উপার্জন করতে পারে। পরিবার ও সমাজে ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমানে এ ধরনের উদাহরণ কম নয়।

আমাদের সমাজে সাধারণত মেয়ে আর ছেলের মধ্যে যে বৈষম্য করা হয় সেগুলো হলো-

পুষ্টিঃ বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের শরীর দ্রুত বাড়ে। তাই এ সময়ে উভয়েরই প্রচুর আমিষ ও ভিটামিনযুক্ত খাবার প্রয়োজন। তবে আমাদের পরিবারগুলোতে প্রায়ই দেখা যায়, তারা ছেলেকে বেশি খাবার দেয়, কিন্তু মেয়ের পর্যাপ্ত খাবারের ব্যাপারে উদাসীন থাকে, ফলে মেয়েটি অপুষ্টিতে ভোগে। শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে বেড়ে ওঠে। অথচ ভবিষ্যতের মা হিসেবে কিশোরীর জন্য পুষ্টি নিশ্চিত করা অনেক বেশি জরুরি ।

শিক্ষাঃ পরিবারে একটি মেয়ে যখন বড় হয়, বাবা-মা বা সমাজ মনে করে সে বিয়ের জন্য উপযুক্ত হয়েছে, সুতরাং তার আর লেখাপড়ার দরকার নেই। এছাড়াও রাস্তাঘাটে মেয়েদের নিরাপত্তার অভাবে অনেক সময় স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে জীবন গঠনে বা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে একটি মেয়ে ছেলেদের চাইতে বরাবরই পিছিয়ে পড়ে। মেয়েরা শিক্ষার সুযোগ পেলে উপার্জন করার সুযোগ পাবে এবং তাহলেই ভবিষ্যতে ছেলে সন্তানের মত পরিবার ও বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিতে পারবে। এ বাস্তবতাবোধ এখনও সমাজ সেভাবে মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। তবে এটাও ঠিক, ধীরে হলেও সমাজের প্রথাগত বা চিরায়ত বৈষম্যমূলক মূল্যবোধগুলোর পরিবর্তন হচ্ছে।

স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাঃ স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রেও মেয়েরা কখনো কখনো অবহেলার শিকার হয়। এমনকি গর্ভবস্থায়ও তার সঠিক যত্ন নেয়া হয় না। ফলে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায় ।

মর্যাদাবোধ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণঃ সাধারণত ছোটবেলা থেকেই একটি মেয়েকে পরিবারে খাটো করে দেখা হয়। ফলে কাজের স্বীকৃতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও তাকে অবহেলা করা হয়। এভাবে মর্যাদাহীনভাবে বেড়ে উঠতে উঠতে মেয়েরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং কখনও কখনও নিজের মর্যাদা বা অধিকারও বুঝতে পারে না ।

মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাঃ ছোট বড় কোনো ধরনের কাজেই মেয়েদের মতামতের মূল্য অনেক পরিবারের সদস্যরা দেয় না। যেমন, মেয়ের অমতে বিয়ে দেয়া, অল্প বয়সে বিয়ে দেয়া, লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়া, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে মিশতে না দেয়া, খেলাধূলা করতে না দেয়া, পরিবারের কোনো বিষয়ে তার মতামত না নেয়া ইত্যাদি।

সম্পদ বন্টনঃ আমাদের দেশে অনেক সময় পরিবারে মেয়েরা তার উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। দেশের উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী মুসলিম পরিবারে মেয়ে সন্তান ছেলে সন্তানের তুলনায় অর্ধেক সম্পত্তি পায়। কিন্তু মহিলা সদস্যরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতনতার কারনে ধরে নেন সম্পত্তিতে শুধুমাত্র ছেলেদেরই অধিকার রয়েছে। অনেক সময় পারিবারিক ও সামাজিক চাপে মেয়েদের এটা মেনে নিতে হয়।

কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যঃ কাজের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়েরই কাজ পাওয়া এবং পারিশ্রমিকে সমান অধিকার রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে কখনও কখনও এই অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। দেখা যায় একটি ছেলে ও একটি মেয়ে একই কাজ করছে কিন্তু তাদেরকে পারিশ্রমিক একই রকম দেয়া হচ্ছে না। মেয়েরা যখন গর্ভবতী হচ্ছে তখন অনেক ক্ষেত্রে তাকে তার প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে না। এমনকি কখনও কখনও মেয়েটা চাকুরি হারাচ্ছে। অথচ কর্মসংস্থান সকল মানুষের মৌলিক অধিকার ।

প্রজনন অধিকারঃ নারী ও পুরুষের প্রজনন অধিকারসমূহ হচ্ছে উপযুক্ত বয়সে বিয়ের অধিকার, কখন এবং কয়টি সন্তান নিতে হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার এবং প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার। অথচ আমাদের দেশের প্রায়ই প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার থেকে মেয়েরা বা নারীরা বঞ্চিত হন।

এই বৈষম্যসমূহ মারাত্নকভাবে একটি মেয়ের বেড়ে ওঠা এবং তার স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করে।

জেন্ডার বৈষম্য
  • পুত্র সন্তানের অগ্রাধিকার
  • মেয়ে সন্তানের কম মূল্যায়ন
  • মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে কম খাদ্য
  • মেয়েদের বাল্য বিবাহ
  • নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কম
  • নারীর প্রজনন ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ কম
  • নারী পুরুষের অসম শ্রম বিভাজন ও সম্পদ বন্টন
  • নারীর উপর আরোপিত ক্ষতিকারক সামাজিক প্রথা
একটি মেয়ে বা নারীর উপর এর নেতিবাচক প্রভাব
  • স্বাস্থ্য ঝুঁকি
  • পুষ্টিহীনতা
  • শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া
  • অধিক অসুস্থতা
  • অধিক মাতৃ মৃত্যু হার
  • মানসিক অসুস্থতা
  • নারীর প্রতি নির্যাতন
  • নারীর মানসিক বিকাশ হয় না
  • নারীকে পরনির্ভরশীল হতে হয়।

বৈষম্যমূলক আচরণ দূর করতে করণীয়

  • কিশোর-কিশোরী এবং নারী পুরুষ উভয়ইকেই ছেলে ও মেয়ের সমান সুযোগ পাওয়ার অধিকার রয়েছে এই বিষয়টিকে উপলব্ধি করতে হবে ।
  • • অভিভাবকদেরকে বুঝতে হবে যে, একজন মেয়েকে সুযোগ দিলে ছেলের মতো প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী একজন কিশোরীকে লেখাপড়া শিখে তৈরি হতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে একজন পুরুষের পাশাপাশি তারাও মাথা উঁচু করে সমানভাবে চলতে পারে।
  • পরিবারের এবং সমাজের নারী সদস্যদের প্রতি ছোটবেলা থেকেই শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। একজন কিশোরকে বা একজন পুরুষকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে তার পরিবারের সকল নারী বা মেয়েরা যেন বৈষম্যের শিকার না হয়।

কিশোরী সদস্য যেন তার মতোই খাবার, শিক্ষা, চিকিৎসা, মতামত দেয়ার স্বাধীনতা, মান মর্যাদা ইত্যাদি পায়।

  • রাস্তাঘাটে কিশোরীদের উত্যক্ত করা, বাজে মন্তব্য বা ইভটিজিং/টিটকিরি করা থেকে বিরত থাকতে হবে ।
  • ছেলে ও মেয়ের সমান সুযোগ পাওয়ার যে অধিকার রয়েছে তা পিতা-মাতা, অভিভাবক, শিক্ষক এবং সমাজের সকলকে বুঝতে হবে এবং ছেলেমেয়েদেরকে সমান সুযোগ দিতে হবে।
  • রাষ্ট্র এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে সরকার ইতোমধ্যে মেয়েদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে এবং এর সুফল একজন নারী, তার পরিবার এবং সমাজ পাচ্ছে।