কিশোরদের বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন

সাধারণত ১০-১২ বছর বয়সে একটি ছেলের শারীরিক পরিবর্তন শুরু হয়। যেমন-উচ্চতা বাড়তে থাকে, কাঁধ চওড়া হয় এবং মাংসপেশি সুঠাম ও সবল হতে থাকে । ছেলেরা যে বড় হচ্ছে তার লক্ষণ হলো দাড়ি-গোঁফ গজানো, বগল ও নাভির নিমাংশে লোম গজায়, লিঙ্গ ও অন্ডকোষ বড় হয়, বীর্য উৎপাদন ও মাঝে মাঝে স্বপ্নদোষ হয়, মেয়েদের প্রতি আগ্রহ তৈরী হয়। এ সময় গলার স্বরেরও পরিবর্তন হয়।

বয়ঃসন্ধিকালে ছেলেদের শরীরের এসব পরিবর্তন হরমোনের কারণে হয়ে থাকে । হরমোন হচ্ছে শরীরের ভেতরে তৈরি এক ধরনের গ্রন্থিরস যা দেহকে সক্রিয় রাখে এবং দেহের বৃদ্ধি ও উন্নয়নে সহায়তা করে । শরীরের গঠন কেমন হবে এ ব্যাপারটা অনেকটাই বংশগত । তবে এখানে সঠিক পুষ্টিরও বেশ প্রভাব রয়েছে ।

এ বয়সে ছেলেদের মূত্রনালী দিয়ে শুক্রাণুযুক্ত রস মাঝে মধ্যে বের হয়ে আসে, কখনো কখনো ঘুমন্ত অবস্থায়ও এ রস বের হতে পারে যাকে ‘স্বপ্নদোষ’ বলা হয়। এই শুক্রাণুই সন্তান জন্মদানের বীজ। স্বপ্নদোষ আসলে দোষের কিছু নয় বরং এটি একজন কিশোরের প্রজননতন্ত্রের স্বাভাবিক বিকাশের পরিচায়ক। এটা ছেলেদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও প্রজনন ক্ষমতা বা সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা অর্জনের লক্ষণ।

কিশোরের স্বপ্নদোষ হলে অবশ্যই সেই কাপড় ধুয়ে ফেলতে হবে। অপরিষ্কার প্যান্ট, লুঙ্গি বা কাপড় পরার কারণে নানা ধরণের চুলকানি ও সংক্রমণ হতে পারে।

বয়ঃসন্ধিকালের ঝুঁকি সমূহ

  • অনেকেই মাদকাসক্তি ও ধূমপানসহ অন্যান্য অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়তে পারে।
  • অবৈধ ও অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক, ফলস্বরূপ অনাকাঙ্খিত গর্ভসঞ্চার, এইচআইভি/এইডস ও অন্যান্য যৌনরোগ হতে পারে।
  • অশ্লীল, অনুমোদিত ও অবৈজ্ঞানিক বই পুস্তক পড়ে ভুল তথ্য জেনে ভুল পথে পরিচালিত হতে পারে।
  • অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের ফলে মোটা হয়ে যেতে পারে। আবার সুষম খাবার না খাওয়ার কারণে রুগ্ন হয়ে যেতে পারে।

বয়ঃসন্ধিকালের ঝুঁকির কারণ

  • প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যা সম্পর্কে সঠিক ও পর্যাপ্ত তথ্য না জানার কারণে কিশোর-কিশোরীরা ভুল পথে পরিচালিত হতে পারে।
  • অভিভাবক ও শিক্ষকগণ প্রজনন স্বাস্থ্য ও বয়ঃসন্ধিকালীন বিষয়ে কিশোর-কিশোরীদের সাথে আলোচনা করতে সংকোচ বোধ করেন। এ কারণে কিশোর-কিশোরীরা বয়সন্ধিকালের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক সঠিক তথ্য পায় না।
  • গণমাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের বয়ঃসন্ধিকাল বিষয়ক অনুষ্ঠান খুব কম। তাই সেখান থেকেও কিশোর-কিশোরীরা বয়ঃসন্ধিকালের প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক সঠিক তথ্য পায় না।
  • গর্ভসঞ্চার ও যৌনরোগ বিষয়ে সঠিক তথ্য ও জ্ঞানের অভাবে তাদের দ্বারা ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের সম্ভাবনা থাকে।
  • অনভিজ্ঞতার কারণে কোনো কাজের পরিণাম না বুঝে ঝুঁকি নেয়ার প্রবণতা।
  • সমবয়সিদের বা বন্ধুদের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়।

বয়ঃসন্ধিকালের ঝুঁকি প্রতিকারে করণীয়

  • বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীরা প্রজনন ক্ষমতা অর্জন করে। তাই এই সময় থেকেই প্রজনন স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রয়োজন। প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে হবে। তাহলে অনাকাঙ্খিত প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ঝুঁকি (এইচ আই ভি /এইডস এবং বিভিন্ন যৌনরোগ) থেকে নিজেকে রক্ষা করা যাবে।
  • ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে মানে শিশু বিয়ে। কারণ ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকাল। তাই শিশুকালে বিয়ে হচ্ছে শিশু অধিকার লঙ্ঘন। এছাড়া কম বয়সে বিয়ে হলে কম বয়সে গর্ভধারণ হয়। ২০ বছর বয়সের আগে গর্ভধারণ মা ও শিশুর স্বাস্থ্য ও জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে নয় এবং ২০ বছর বয়সের আগে গর্ভধারণ নয়।
  • কিশোরীরা অনেক সময় যৌন নির্যাতন কী তা ঠিক বুঝতে পারে না, তাই তারা প্রতিরোধ করতে বা নিজেকে রক্ষা করতে পারেনা। যৌন নির্যাতন সম্পর্কে জানতে হব, তাহলে নিজেদেরকে যৌন নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে পারবে। বাবা-মাকে এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
  • কৈশোরে বন্ধুবান্ধব থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু যে কোনো কাজ করার আগে বুদ্ধি বিবেচনা কাজে লাগিয়ে বুঝতে হবে কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ।
  • বাবা-মা, ভাই-বোন সকলের সাথে বন্ধুত্ব্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে হবে। মনে যে কোনো প্রশ্ন আসলে কিংবা কোনো সমস্যায় পড়লে তাদের সাথে খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। তাদের সাহায্য সহযোগিতা চায়তে হবে।
  • পড়াশোনা, খেলাধুলা, ও সমাজ কল্যাণ কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে, যাতে নিজেকে বিপদজনক বা অসামাজিক কাজ থেকে সরিয়ে রাখা যায়।
  • এ সময় পুষ্টিকর ও সুষম খাবার খেতে হবে।
  • মাদককে না বলতে হবে।
  • বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর-কিশোরীদের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হতে পারে বাবা -মা। কিন্তু অনেক সময় দূরত্ব তৈরি হয়। এক্ষেত্রে বাবা-মাকে এগিয়ে আস্তে হবে বয়ঃসন্ধিকালের সন্তানদের জন্য, তাদেরকে প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে হবে।
  • এ সময়ে কিশোর-কিশোরীরা নিজেদের চিন্তাভাবনা ও ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করতে চায় । বাবা-মার আদেশ-উপদেশ তাদের ভালো লাগে না । মনে করে বাবা-মা তাদের চিন্তাভাবনা, ইচ্ছা বা অনুভূতি বুঝতে পারেন না । কিন্তু বাবা-মাই হচ্ছে সবচেয়ে আপনজন এবং তারা সবসময় সন্তানের কল্যাণ কামনা করেন । তাই তাদের কথা বুঝতে চেষ্টা করতে হবে ।
  • বাবা-মায়েরা বয়স্ক মানুষ এবং জীবন সম্পর্কে তাদের অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতা রয়েছে । তারা ভালোভাবেই জানেন যে, সমাজে কেবল ভালো জিনিসই নেই, খারাপ জিনিসও রয়েছে । তাই এই বয়সে বাবা-মায়ের নির্দেশনা খুবই প্রয়োজন । তাই এ সময়ে যদি নিজেদের সমস্যা নিয়ে বাবা-মায়ের সাথে খোলাখুলি আলাপ করা এবং তাদের পরামর্শ নিয়ে চলা হয় , তাহলে সমস্যা অনেক কমে আসবে ।