মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হ্রাসে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ

মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হ্রাসে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী গত ১৫ বছরে দেশের মাতৃ মৃত্যুর হার প্রায় ৬০ শতাংশ এবং শিশু মৃত্যুর হার প্রায় অর্ধেক কমেছে। ১৯৯০ সালে সন্তান জন্ম দেয়ার সময় প্রতি ১ লাখ নারীর মধ্যে ৫৭৪ জন মারা গেছেন, এই সংখ্যা কমে ২০০১ সালে ৩২২ এবং ২০১১ সালে তে নেমে এসেছে। দেশে বর্তমানে প্রসবজনিত মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৭০ জন। বাংলাদেশ এই সংখ্যা ২০১৫ সালের মধ্যে ১৪৩এ নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

 

বাংলাদেশে এ সফলতার পেছনে সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি বিদেশি এনজিওগুলোর সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইউএসএআইডি, সেভ দ্যা চিলড্রেন ।

 

শিশুমৃত্যু হার কমাতে ইতিমধ্যেই সফলতা অর্জন করেছে ইউএসএআইডি, কইকা এবং সেভ দ্যা চিলড্রেন কোরিয়ার সহায়তায় পাইলট প্রজেক্ট “মা মনি”। সিলেটে জৈন্তাপুর সারা দেশের তুলনায় একটি দুর্গম স্থান । ২০১৩ সালের এক জরিপে দেখা যায় নানা কারণে এই উপজেলায় একটু বেশিই ছিল শিশুমৃত্যুর হার। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী প্রতিহাজারে ২৯.৮ জন শিশু মারা যেত প্রসবজনিত নানা জটিলতায়। বিষয়টি মাথায় রেখে “মা মনি” প্রকল্পটি পরীক্ষামূলক ভাবে এই উপজেলাতেই শুরু হয়। ২০১৩ সালের মার্চ থেকে ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত “মা মনি”র সেবার কারণে শিশু মৃত্যুর হার নেমে আসে হাজারে ২৩.৬ জনে। জৈন্তাপুর হাসপাতালে স্থাপিত মা-মনি প্রকল্পের নবজাতকের বিশেষ সেবা ইউনিট ঘুরে দেখা গেল, প্রকল্পের এই সময়ের মধ্যে ৭৭৯ জন অসুস্থ নবজাতককে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩৫ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করা হয়। ৭৭৯ জন শিশুর মধ্যে ২৭ জন শিশু মারা যায়। মোট ভর্তির ৩.৪৬ শতাংশ। প্রকল্প চলাকালীন সময়ে প্রতিদিন গড়ে ৪১ জন শিশু বিশেষ এই সেবা সেন্টারে ভর্তি হয় বলে কর্মকর্তারা জানান। বিষয়টিকে সফলতা হিসেবে ধরে নিয়ে ২০১৫ সালের জানুয়ারী থেকে শিশুর সাথে মায়ের সেবার জন্য নতুন প্রকল্প “মমতা” কাজ শুরু করেছে। এই প্রকল্পে সহায়তা করছে কইকা, সেভ দ্যা চিলড্রেন কোরিয়া । “মমতা” প্রকল্পের অধীনে জৈন্তাপুর ছাড়াও আরও দুটি সুবিধাবঞ্চিত এলাকা কোম্পানীগঞ্জ এবং গোয়াইনঘাট উপজেলাকে আনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলে মনে করেন বিদেশি সহায়তা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিটি উপজেলায় এ ধরনের ব্যবস্থা করতে পারলে খুব দ্রুতই মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।

 

তবে এর জন্য বিজ্ঞানসম্মত প্রসূতি সেবাদানের পাশাপাশি অশিক্ষা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন দেশের মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। নারীদের মধ্যে শিক্ষা সুবিধা বাড়াতে হবে। চিকিৎসাসেবা সবার দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিতে হবে। বাল্যবিয়ে রোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে গ্রাম, উপকূলীয় ও পার্বত্য অঞ্চলকে প্রাধান্য দিতে হবে।

 

মাতৃমৃত্যু রোধে এমডিজি অর্জনে সক্ষম দেশগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যেসব দেশে প্রসবকালীন দক্ষ সেবার ব্যবস্থাপনা রয়েছে, সে সব দেশে মাতৃমৃত্যু অনেক কমে গেছে। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখালেও প্রসবকালীন দক্ষ সেবার অভাব রয়েছে।

 

বিশেষজ্ঞদের মতে বর্তমানে শতকরা ১৫ ভাগ প্রসব বিভিন্ন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে হয়ে থাকে। বাকি ৮৫ ভাগ বাড়িতে অদক্ষ দাই অথবা নিকটাত্মীয়ের দ্বারা হয়। গ্রামাঞ্চলের ৯০ ভাগ মহিলার প্রসব এখনও হয়ে থাকে সনাতন দাইমা অথবা আত্মীয়-স্বজনের সাহায্যে। এছাড়াও কিশোরী মায়ের মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ৬ জন। দেশের পার্বত্য অঞ্চলের অবস্থা আরও ভয়াবহ। এসব জায়গায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র অনেক দূরে। সেখানেও সর্বক্ষণ ডাক্তার থাকেন না। তাই এসব এলাকার ৯০ ভাগ শিশু ধাত্রীদের হাতে ঘরেই জন্ম নেয়। এসব এলাকায় মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার অন্যান্য জেলার তুলনায় অনেক বেশি।

 

অধিকাংশ নারী তার গর্ভকালীন অথবা সন্তান প্রসবকালে কোনো চিকিৎসকের সঙ্গে আলাপ করার ক্ষেত্রে দ্বিধায় ভোগেন। তারা নানা ধরনের জটিলতায় ভুগলেও চিকিৎসকের কাছে যেতে চান না। বাংলাদেশে মাতৃ ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তরুণ ও বয়স্ক নারীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দারিদ্র্য এখানে মূল সমস্যা নয়। তাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব অন্যতম কারণ। সচেতনতা বাড়াতে পারলেই মাতৃমৃত্যু রোধে আরও অগ্রগতি সাধন সম্ভব।

 

তবে মাতৃমৃত্যু হার কমাতে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে জরুরি প্রসূতিসেবা নিশ্চিত করায়। এ লক্ষ্যে ৫৯টি জেলা হাসপাতাল এবং ১৩২টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি প্রসূতিসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। ৫৯টি জেলা জেলা হাসপাতালে এরই মধ্যে ১৪টি জেলার ২০টি উপজেলায় ৩৪টি হাসপাতালকে নারীবান্ধব করা হচ্ছে। জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) এই প্রকল্পে সহায়তা করছে।

 

সরকার ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) পাশাপাশি অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী ও বেসরকারি সংস্থাগুলো নানা কর্মসূচি ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে রয়েছে, সন্তান প্রসবপূর্ব মায়ের যত্ন, দরিদ্র নারীর জন্য মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার প্রকল্প, কমিউনিটিভিত্তিক স্কিলড বার্থ অ্যাটেনডেন্টস (এসবিএ) নিয়োগ ও মিডওয়াইফারি কর্মসূচি।

 

ইউএনএফপিএর এর তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে শতকরা প্রায় ৪২ জন গর্ভবতী মা প্রশিক্ষিত ধাত্রীর পরিচর্যায় নিরাপদ প্রসবের আওতায় এসেছেন। বাকি মায়েরা ঘরেই ধাত্রী ছাড়া অন্যের সহায়তায় সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। এর ফলে মৃত্যুর ঝুঁকি ছাড়াও মায়েরা প্রসব-পরবর্তী নানা রকম স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। তৃণমূল পর্যায়ে জনসচেতনতা বাড়াতে পারলে মাতৃমৃত্যু হার আরও হ্রাস পাবে। গ্রাম পর্যায়ে দরিদ্র লোকদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে স্বাস্থ্যসেবা বাড়াতে জোর দেয়া হচ্ছে।

 

বিশ্বের যে কয়েকটি দেশ জাতিসংঘ ঘোষিত মাতৃমৃত্যু হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। এমডিজি অনুযায়ী, বিশ্বের দেশগুলোতে ২০১৫ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যুর হার ২০০০ সালের তুলনায় তিন-চতুর্থাংশ কমাতে হবে। কিন্তু ২০১৫ সালে এসেও অনেক দেশ তাদের অগ্রগতি সন্তোষজনক পর্যায়ে আনতে পারেনি। তবে বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। বলা যায়, মাতৃমৃত্যু রোধে বাংলাদেশ এখন বিশ্ব উদাহরণ, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এটা ধরে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ, এমন প্রত্যাশা তাদের।

 

মাহবুবুর রহমান রিপন

ব্যুরো প্রধান, যমুনা টেলিভিশন, সিলেট

Reference: www.voabangla.com